সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন

একাত্তরের রণাঙ্গন

একাত্তরের রণাঙ্গন

প্রথম পর্ব:

একাত্তরের মাঝামাঝি সময়। ভারতের ‘মেলাঘর’ নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে এবং তাবু গেড়েছে ১৫ জনের এক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দল। জায়গাটি অনেকটা মালভূমির মতো উচু। কাছেই প্রবাহমান তিতাস নদী এবং ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। নিঝুম রাত্রিতে তাবুতে শুয়ে আছে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নাট্যকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ, অভিনেতা রাইছুল ইসলাম আসাদ, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান শহীদ রুমী, আজকের রাজনীতিবিদ মোফাজ্জল হোসেন মায়া প্রমুখ বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা। কারো চোখে ঘুম নেই, একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে। কারণ গতরাতে তারা পাক হানাদারদে ফাঁদে পড়ে ৪৪জন মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছে। রাত্রির শেষ পর্বে, ভোরের উষালগ্নে একটি সামরিক জীপে চড়ে ক্যাম্পের সামনে এসে দাড়াল সেক্টর কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশারফ ও বিষ্ফোরক বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন হায়দার। তাদের সঙ্গে ১৫ বছরের এক কিশোর। তার নাম টিটু। জীপের শব্দ শুনে তাবু থেকে বেড়িয়ে আসল নাসির উদ্দিন ইউসুফ, আসাদ, রুমি গংরা। ওদের কাছে বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশারফ শুনল গত রাত্রের মর্মান্তিক ঘটনা এবং রাগত স্বরে বলল-‘স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা দেখতে দেখতে চায় না।’ আর খালেদ সাথে থাকা কিশোর ছেলেটিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল: নাসির ওকে প্রশিক্ষণ দাও। অস্ত্র চালানো শেখাও, এক্সক্লোসিভ ব্যবহার করা শেখাও। রাইছুল ইসলাম আসাদ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, খালেদ স্যার এতো একেবারে বাচ্চা ছেলে। খালেদ স্যার, টিটুর কাঁধে হাত দিয়ে বলল “ হি ইজ দ্যা মাস্টবি মাই বেষ্ট লিটল ফ্রিডম ফাইটার।” ওদের কথাবার্তা শুনে কিশোর টিটু বলে উঠল, আমি অস্ত্র চাই, আমি ট্রেনিং চাই। কারণ পাক হানাদাররা আমার ভাইকে ২১বার বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করেছে। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। আমি বাংলার মাটি থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই। শুরু হলো টিুটুর মুক্তির সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ।

দ্বিতীয় পর্ব:
মাত্র পনের দিনের মধ্যেই টিটো ট্রেনিং দিয়ে হয়ে গেলো এক পুরদস্তুর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। কাজী কামাল, মানিক, সাদেক হোসেন খোকা, আজাদ, রুমিদের মতো গেরিলাদের সাথে কয়েকটি অপারেশনে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে টিটোর উদ্যম আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু ঢাকা সংলগ্ন ‘ডুবিব্রীজ অপারেশনে’ কমান্ডার মানিক নিহত হলে টিটো আবারও মর্মাহত হয়ে গেলো। মনে পড়লো পাক হানাদার কর্তৃক নিহত ভাই তেজোর কথা। টিটো কমান্ডার মানিকের রক্ত ছুঁয়ে শপথ করল- যতদিন পর্যন্ত দেশকে শত্রু মুক্ত করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে দেখা করব না। কিশোর টিটোর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলো তার মা। তাই মায়ের নামে কসম খেয়েছিল। দেশ শত্রু মুক্ত হয়েছিল কিন্তু টিটোর বাড়ি ফেরা হলো না; মায়ের মুখ দেখা হলো না।
যুদ্ধের নিষ্ঠুর পরিহাস। মুক্তির দু’দিন পূর্বে ঢাকা ঢোকার অন্যতম পথ আমিন বাজার ব্রীজটি কোন ক্রমেই মুক্তি মুক্তিযোদ্ধারা ক্রস করতে পারছিল না। রাজধানী ঢাকা জয়ের জন্য এটি ছিলো একটি বিরাট ট্রাজিডি। তাই এ বিষয়টির উপর নজর ছিলো বাঙালির সামরিক অফিসার মেজর জিয়া, মেজর শফিউল্লাহ ও ক্যাপ্টেন হায়দার প্রমুখ। উনারা মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন ইউসুফের কাছে ম্যাসেজ পাঠালো, ব্রীজের অপর পাড়ে পাক হানাদারদের জনবল ও সামরিক শক্তিসম্পর্কে সোর্স মারফত খোঁজ নিতে। এবার বীরের দায়িত্ব নিলো টিটো। সাঁতরিয়ে নদী পাড় হলো; পাক হানাদারদের সকল খবরাখবর নিয়ে আমার বিপরীত পাড়ের সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছলো, বার্তা দিতে শুরু করল। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে পাক হানাদারদের একটি বুলেট পেছন দিক থেকে তার পিঠ ছেদ করে ঢুকে গেলো। রক্তাক্ত টিটোর দেহ লুটিয়ে পড়ল নদীর কিনারায়। তখন টিটো মুক্তিযোদ্ধা রাইছুল ইসলাম আসাদকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল “ভাই, আমার দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। আপনাদের কি মনে আছে? বিগ্রেডিয়ার খালেদ সার বলেছিলেন ‘স্বাধীন দেশ কোন জীবীত গেরিলা যোদ্ধা চায় না। মৃত্যুই গেরিলাদের সম্মান।’ তাই আজ আমি মৃত্যুর পথে। অত:পর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মুক্তিবাহিনী তুমুল যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রীজটি দখল করে। এবং সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের পাশর্^বর্তী এলাকায় সামারিক মর্যাদায় টিটোর লাশ দাফন করে। আজ আমরা বলব- কিশোর মুক্তিযোদ্ধা টিটো, তোমায় লাল সালাম।

 

আমরুন্নাহার মৌ
নিজস্ব প্রতিবেদক

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana