শুক্রবার, ২০ Jun ২০২৫, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

কুলিয়ারচরের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ

কুলিয়ারচরের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ

মোঃ মাইন উদ্দিন, কুলিয়ারচর প্রতিনিধিঃ
জন্ম নিবন্ধন ফিস সরকার নির্ধারিত ৫০ টাকা হলেও কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে প্রতি নিবন্ধনে ২০০ টাকা করে নিচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদেে সংশ্লিষ্টরা। নিবন্ধন ফিস ৫০ কেন? জিজ্ঞেস করা হলে পরিষদের তথ্য সেবা কর্মী নাহিদা আক্তার বলেন, প্রতি নিবন্ধন ফিস ২০০ টাকা করেই দিতে হবে।
কথাগুলো এ ভাবেই ব্যক্ত করেলেন গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের শ্বশানী পাড়া গ্রামের মো. লোকমান হোসাইন (৩০) ও লক্ষ্মীপুর কাঁচারীপাড়া গ্রামের মোঃ আলী সোহেল (৩৪) নামে দুই ব্যক্তি। এ ঘটনায় গত ৩১জুলাই মোঃ লোকমান হোসাইন তার ব্যবহৃত ফেসবুক আইডি থেকে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছেন।
লোকমান হোসাইন বলেন, গত ৩১ জুলাই তিনি ৪টি নিবন্ধন করতে ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য সেবা কেন্দ্রে যান। তথ্য সেবা কেন্দ্রের দ্বায়িত্বে থাকা নাহিদা আক্তার নামে এক নারী ৪টি নিবন্ধনের জন্য তার নিকট ৮০০ টাকা দাবী করেন। প্রতি নিবন্ধন ফিস ৫০ টাকার জায়গায় ২০০ টাকা করে কেন জিজ্ঞেস করা হলে তথ্য সেবা কর্মী নাহিদা আক্তার বলেন ৪টি নিবন্ধন করতে হলে ৮০০ টাকাই দিতে হবে তাকে। তা না হলে নিবন্ধন করতে পারবেনা। পরে নাহিদা আক্তারের কথা মতো ৪টি নিবন্ধনের জন্য তার হাতে ৮০০ টাকা তুলে দিয়ে এসেছি।
আলী সোহেল বলেন, ৮০০ টাকা দেওয়ার সময় লোকমান হোসাইন এর সাথে তিনিও ছিলেন। টাকা দেওয়ার সময় পাশের চেয়ারে ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নিলুফা আক্তার বসা ছিলেন।
এ ছাড়াও পূর্ব আব্দুল্লাহপুর গ্রামের শাহীন সুলতানা (৪৫) নামে এক নারী ফেসবুকে ২টি কমেন্ট করে জানিয়েছেন “আমার কাছ থেকেও ২০০ টাকা নিয়েছে। সবার কাছেই ২০০ টাকা নেয়। এমনই ভাবে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেলোয়ার হোসাইন নামে এক ব্যক্তি বলেন, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদে সরকার কর্তৃক জম্মনিবন্ধন নির্ধারিত ফি থেকে বেশি অর্থ নেওয়ায় সাধারণ জনগণ ভোগান্তি ও হেস্ত-নেস্তর অন্ত নাই। এ অবস্থায় গ্রামের মানুষের কষ্ট বুঝার মতো কি কেউ নাই? আমরা চেয়েছিলাম ১নং গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র ভেজাল, দূর্নীতি ও জনগণের হয়রানি মুক্ত হোক, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা সরকার নির্ধারিত আইন বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিদিন হচ্ছে। আমি তাদের এহেন কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানাছি।
আসমত রাজিব নামে এক ব্যক্তি বলেন, পরিষদের উপর তলায় বসা থাকে যে মহিলাটি (নাহিদা আক্তার) উনার ব্যবহার অত্যন্ত বাজে এবং কর্কশ। কিভাবে মানুষের সাথে কথা বলতে হয় সেটা আমার মনে হয় কোন দিনই শেখেননি। একদিন উনার সাথে তুমুল তর্ক হয়ছে নিবন্ধনের টাকা নিয়ে। তারপর নিজের ওজনের কথা বিবেচনা করে পিছপা হয়ে এসেছি। আপনারা যারা সাংবাদিক আছেন, অতি দ্রুত এই অপকর্মগুলো ইউএনও স্যারকে অবগত করুন। তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৭ এর বিধি ২৩ এর উপ-বিধি (৭) এর ক্ষমতাবলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফিস পুন:নির্ধারণ করেছে সরকার। জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিন পর্যন্ত যে কোন শিশুর জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন বিনা ফিসে করা যাবে। জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিন পর হইতে ৫ বছর পর্যন্ত কোন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন (সাকুল্যে) ২৫ টাকা দেশে নিবন্ধন করা যাবে। জন্ম বা মৃত্যুর ৫ বছর পর কোন ব্যক্তি জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন (সাকুল্যে) ৫০ টাকা দেশে নিবন্ধন করা যাবে। জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য আবেদন ফিস ১০০ টাকা। জন্ম তারিখ ব্যতিত নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা ইত্যাদি অন্যান্য তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন ফিস ৫০ টাকা বাংলাদেশে জন্ম হলে। বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় মূল সনদ বা তথ্য সংশোধনের পর সনদের কপি সরবরাহ পাওয়া যাবে বিনা ফিসে। বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় নকল সরবরাহ পাওয়া যাবে ৫০ টাকা ফিস জমা করে। উপরোক্ত ফিগুলো রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানা যায়, উপজেলার ১নং গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে ইচ্ছেমতো অর্থ আদায়, এ কাজে ১৫ থেকে ৩০ দিনেরও অধিক সময় লাগা, চেয়ারম্যানের বাড়ির লোক দিয়ে সরকার নির্ধারিত ফি থেকে ৩ গুণ, এমনকি এরও বেশী টাকা নিয়ে নিবন্ধনের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করাসহ নানারকম অসংগতির অভিযোগ উঠেছে। যা তদন্ত করলে দূর্নীতির প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এলাকাবাসী।
ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমের জটিলতা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। অতীব গুরুত্বপূর্ণ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম সময়মতো সম্পন্ন করতে না পারায় সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
জনগুরুত্বপূর্ণ জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রমে ধীর গতি এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক নিযুক্ত তার অনুগত ও এলাকার যুবক মোঃ জিল্লুর রহমান (নজরুল) ও নাহিদা আক্তারের অদক্ষতা ও খামখেয়ালির কারণে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে ইউপি সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জন্ম নিবন্ধন ডেস্কের সামনে সেবা প্রত্যাশী সাধারণ মানুষের জটলা নিত্যদিনের। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা তথ্য সেবা কর্মী কম্পিউটারের সামনে বসে প্রতি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে নগদ ২০০ টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে ১৫ দিন থেকে ৩০ দিন পর যোগাযোগ করার জন্য বলছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাহিদা আক্তার ও মোঃ জিল্লুর রহমান (নজরুল) চেয়ারম্যানের নিজ এলাকার হওয়ায় তাদের দাপটে অনেকেই মুখ বন্ধ করে তাদের দূর্ব্যবহার সহ্য করে যাচ্ছে। তাদেরকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমের জন্য নিযুক্ত করা হলেও তাদের অদক্ষতার কারণে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত সময় লাগছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজে সকল কাজ করতে পারেননা বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনলাইন আবেদন করে আনার পরও তারা প্রিন্ট কপির জন্য ২০০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের নিকট থেকে।
আরো জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওই ইউনিয়নের স্থায়ী এক বাসিন্দা তার নিজের ও এক সহকর্মীর মোট ৪টি প্রত্যয়নপত্র আনতে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে চেয়ারম্যানকে অফিসে না পেয়ে প্রত্যয়নপত্রে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্যের স্বাক্ষর নিয়ে ইউপি সচিব মোঃ তাজুল ইসলামের নিকট যান। পরে ইউপি সচিব তাদের দু’জনের ৪টি প্রত্যয়নপত্রে স্মারক নং যথাক্রমে- ৪৯৪/২০২২, ৪৯৫/২০২২, ৪৯৬/২০২২ ও ৪৯৭/২০২২ এবং তারিখ- ১৫/০৯/২০২২ উল্লেখ করে একটি করে গোল সীল ও একটি করে চেয়ারম্যানের নামের সীল দিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে স্বাক্ষর আনার জন্য বলেন। এর পরদিন স্বাক্ষর আনার জন্য চেয়ারম্যানের পার্শ্ববর্তী বাড়ির ফরহাদ মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে পাঠালে রহস্যজনক কারনে ওই চেয়ারম্যান ফরহাদ মিয়াকে অকথ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালি গালাজ করে প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর না দিয়ে প্রত্যয়নপত্র ৪টি রেখে আসার জন্য বলেন। চেয়ারম্যান স্বাক্ষর না দেওয়ায় ফরহাদ মিয়া প্রত্যয়নপত্র ৪টি নিয়ে চলে আসেন।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে অতিরিক্ত ফিস নেওয়ার বিষয়ে নাম প্রকাশে একাধিক ইউপি সদস্য বলেন, চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এনামুল হক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন থেকে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত নিয়েছেন। অতিরিক্ত টাকা থেকে পরিষদের কোন প্রকার উন্নয়ন কাজ করেননি। এমনকি তাদেরকেও কোন ভাগ দেয়নি। সকল টাকা চেয়ারম্যানের হেফাজতেই রয়েছে।
এ ব্যাপারে তথ্য সেবা কর্মী নাহিদা আক্তার সেবা গ্রহীতাদের নিকট থেকে ২০০ টাকা করে নেওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ৫০ টাকা সরকারি ফি। ৫০ টাকা তাদের খরচ। বাকী ১০০ টাকা পরিষদে থাকা নজরুলের কাছে জমা দিতে হয়।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এনামুল হকের সাথে সাংবাদিকরা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম লুনা’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana