শুক্রবার, ২০ Jun ২০২৫, ০৪:২২ পূর্বাহ্ন

কুলিয়ারচরের গিটটু পাগলা নামে খ্যাত তাহের মিয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পায়নি রাষ্টীয় স্বীকৃতি

কুলিয়ারচরের গিটটু পাগলা নামে খ্যাত তাহের মিয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পায়নি রাষ্টীয় স্বীকৃতি

তাহের মিয়া

মোঃ মাইন উদ্দিন, কুলিয়ারচর প্রতিনিধি :

বন্ধু আল-আমীন ভূঁইয়া টিংকুর সাথে বাইক যুগে চলছি জাফরাবাদ কাচারী বাজারের দিকে। বাজার থেকে বাইকেই বাজারের পূর্বপাশের আাঁকাবাঁকা পথ ধরে যাচ্ছি ধীর গতিতে। পথের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের পুরনো লিচু গাছ আর কলা বাগান। এসব পেরিয়ে একটু সমনে গিয়েই একটি বাড়ি। বাড়ির পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশ জুড়ে কলা বাগান। বাগনের মধ্যে একটি ঘর। ঘরের বারান্দায় সোয়ে আছে ৭২ বছর বয়সী এক পাগলা। তাঁর গায়ে ছেঁড়া কাপড়, নেই গোসল, এ অবস্থায় পড়ে আছে। বাড়ির উঠোনে পাক হচ্ছে বুনা খিচুরি, রান্না ঘরে ভাত আর গরুর মাংস। যারা পাক করছে তাদের বাড়ি একই উপজেলার পার্শবর্তী ফরিদপুর ইউনিয়নে। এ সময় তাদের সাথে আসা কিছু মহিলাকে পাগলার যত্ন করতে দেখা যায়। স্থানীয়রা জানায়, পাগলার জীবনে কোনো সংসার পাতেনি। তাঁর কোনো ছেলে-মেয়ে নেই, সে এখন একা, বড়ই একা। যির্ঝশীর্ণ শরীর। মনে হয় গোসল করেনি বহুদিন। কিন্তু অবাক হলেও সত্য, তাঁর কাছাকাছি গেলেও শরীর থেকে কোনো দুর গন্ধ আসেনি। আমি এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া-আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের জাফরাবাদ কাঁচারিপড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মন্নাফের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তাহের মিয়া ওরুফে গিটটু পাগলা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর গিটটু পাগলার বাড়িতে বসে কথা হয় তাঁর আপন ভাতিজা মোঃ হাবিবুর রহমানের পুত্র কলেজ পড়ুয়া ছাত্র মোঃ জীবন মিয়ার সাথে। জীবন মিয়া জানান, পাগলা তার দাদা হয়। নাতির ভাষ্যমতে মোঃ তাহের মিয়া ওরুফে গিটটু পাগলা কিশোর বয়সে হাডুডু, ফুটবল খেলাসহ বিনোদন পছন্দ করতেন। বিনোদন প্রিয় তাহের মিয়া ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২১ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংগ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর মাঝে চলে আসে নিরবতা। বন্ধ হয় কথা বলা। কারোর সাথে বলতে চায় না। এই সমস্যা দেখা দেওয়ার পর তিনি বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যায় এরপর তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন পর জানা যায়, তিনি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে কখনো এ রাস্তায়, কখনো সে রাস্তায় পড়ে থাকে। জানার পর তাঁর ভাই-ভাতিজারা তাকে আনতে গেলে তিনি তাদের সাথে বাড়িতে আসতে অস্বীকৃতি জানান। এভাবে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে ২৪/২৫ বছর সময় অবস্থান করে পরে তিনি চলে যায় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে তিনি ৮/১০ বছর অবস্থান করে আবারও চলে আসেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে। ওইখানে এসে তার স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা দিলে পরে তিনি তার নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়নের হযরত আবু আলী আক্তার উদ্দিন শাহ্ কলন্দর গউস পাক (রঃ)’র মাজার শরীফে চলে আসেন। ওই মাজারে ১২/১৪ বছর অবস্থান করার পর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি দেখা দেয়। পরে তিনি চলে আসেন তাঁর নিজ বাড়ি গোবরিয়া-আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের জাফরাবাদ কাচারি পাড়া গ্রামে। বর্তমানে ৫/৬ বছর যাবৎ তিনি তাঁর আপন ভাতিজা মোঃ হাবিবুর রহমানের বাড়িতে হাবিবুর রহমানের তথ্যাবধানেই আছেন। পাগলার ভাতিজা মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, তার চাচা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি “মুক্তিবার্তা-৭৫” নামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা বেড় করে এনে দেখা। মুক্তিবার্তা-৭৫ নামের তালিকায় মোঃ তাহের মিয়া নাম থাকতে গেছে। তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তাহের মিয়ার নাম্বার ০১১৭০৯০৩৬৫। হাবিবুর রহমান আরও বলেন, আমার চাচা এখন ভারসাম্যহারিয়ে ফেলছে। তিনি যখন সুস্থ সবল ছিলেন তখন তাকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বিষয়ে বললে তিনি বলতেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশ স্বাধীন করেছি দেশ ও দেশের মানুষের জন্য বিনিময়ে টাকা আনবো কেন? এছাড়াও তাঁর জীবনে টাকা-পয়সা, ধনসম্পদের প্রতি কোনো লোভ লালসা ছিলনা। হাবিবুর রহমানের দাবি, অন্তিমকালে চাচা যদি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্টীয় স্বীকৃতি পেতো, সম্মানি ভাতা পেতো তাহলে আমার চাচার আত্মা শান্তি পেতো। বন্ধু আল-আমীন ভূঁইয়া টিংকুসহ পাগালার কয়েকজন ভক্তবৃন্দ বলেন, তিনি বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানকালে তাঁর ভক্ত বৃন্দগন তাকে যেসব টাকা-পয়সা দিতেন সেসব টাকা-পয়সা তিনি নিজে না খেয়ে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। অর্থাৎ তাঁর মাঝে টাকা-পয়সা অর্থ-সম্পদের কোনো লোভ লালসা ছিল না। এমনকি এখনও নেই। তাঁর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি শুধু একটা কথাই বলেন, আমারে যে বানাইছে সেই মাটির ভিরতে নিয়া যাইবো। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একই কথা বলেন, কয়দিন পরে মাটির ভিরতে যাইয়ামগা ইতা দিয়া কি করুম।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana