বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩, ১০:০৯ অপরাহ্ন
[ বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক ও কলামিষ্ট, বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সহচর এম.আর আক্তার মুকুলের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইয়ের মুখবন্ধ থেকে প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে।]
আমি এখন প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে। সেই কবে ব্রিটিশ আমলে জন্মগ্রহণের পর যখন বুঝতে শিখলাম, তখন মাষ্টারদা’র চট্টগ্রামে স্বাধীনতার প্রথম প্রচেষ্টাকে-ভয়াবহ দমননীতির মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে ইংরেজ শাসকদের শোষন ও অত্যাচার দেখলাম। এরপর দেখলাম দ্বিতীয় যুদ্ধের ধ্বংসলীলা আর কংগ্রেসিদের অসহযোগ আন্দোলন। এলো তেতাল্লিশের সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ। বাঙলার পথে-প্রান্তরে আত্মাহুতি দিলো প্রায় পঞ্চাশ লাখ আদম সন্তান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যখন পরিসমাপ্তি, তখন আমি দিনাজপুরে সবেমাত্র কলেজের চৌহদ্দিতে ঢুকেছি। তরুণ তাজা মন নিয়ে অবাক বিস্ময়ে কৃষকদের প্রাণের দাবি তেভাগা আন্দোলনের সর্বাত্মক চেহারাটা উপলব্ধি করলাম। এলো ছেচল্লিশের সাধারণ নির্বাচন। মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। স্লোগান দিলাম ‘হাত মে বিড়ি মুমে পান লড়কে লেংগে পাকিস্তান’। শুরু হলো ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ঠিকভাবে সব কিছু বোঝার আগেই এক হাজার মাইল ব্যবধানে দুটো অংশ দিয়ে গঠিত পাকিস্তান নামে একটা নাগরিক হলাম। বাঙালি হিন্দু শরণার্থী আর অবাঙালি মুসলিম মোহাজেরদের ভয়াবহ দুর্দশার পাশাপাশি ভারত থেকে আগত বিত্তশালী মুসলিমদের ‘শরাফত’ আর ‘খান্দানীদের’ দাপট ভোগ করলাম। আরবি হরফে বাংলা, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার হুমকি শুনলাম। আটচল্লিশের প্রথম ভাষা আন্দোলনের সময় মনের গহনে সন্দেহের বীজ বপন হলো। তাহলে কী আমরা সা¤্রাজ্যবাদের জগদ্দল পাথর থেকে বেরিয়ে উপনিবেশবাদের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছি?
আরপর এই বেড়াজাল ছিন্ন করতে আমাদের আরও ২৩ বছর সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। ঊনপঞ্চাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নি¤œপদস্থ কর্মচারী ধর্মঘট, এবং রাজশাহী ও দিনাজপুরে ছাত্র-বিক্ষোভ, পঞ্চাশে দাঙ্গা-বিরোধী বক্তব্য পেশ, একান্নতে বিপিসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বাহন্নোতে ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোতে সাধারণ নির্বাচন ও ৯২ (ক) ধারার বিরোধীতা, ছাপ্পান্নোতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, আটান্নোতে আইয়ুবের সামরিক শাসন, বাষট্টিতে শিক্ষানীতি-বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভ, ছেষট্টির ছ’দফা, আটষট্টির ‘ষড়যন্ত্র মামলা’, উনত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের ঘুর্ণিঝড়, সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ঐতিহাসিক বিজয় ও স্বাধিকার আন্দোলন, একাত্তরে গণহত্যার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ। এসব কিছু হয় অন্তরঙ্গ আলোকে দেখেছি, না হয় নিজেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি।
আবার স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে যুদ্ধবন্দি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়াই মুক্তি, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পদত্যাগ, মার্কিনি অসহযোগিতায় রংপুরের দুর্ভিক্ষ, প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির প্রবর্তন, বিতর্কিত বাকশালের সৃষ্টি, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যা, দক্ষিণপন্থীদের ক্ষণস্থায়ী অভ্যুত্থান, আটাত্তরে জাতীয়তাবাদী স্লোগানের আড়ালে দক্ষিণ ও মধ্যবিত্ত-সুলভ বামপন্থীদের মেরুকরণ, একাশিতে জিয়া হত্যা, বিরাশির শুরুতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অরাজকতা এবং সামরিক সরকার এরশাদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর-এ সব কিছুই কালের নীরব সাক্ষী হিসাবে অবলোকন করলাম।
এতসব অভিজ্ঞতার আলোকে অনুভব করলাম আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য অন্ততপক্ষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী দুই দশকের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট লিপিবব্ধ করা বাঞ্জনীয় হবে। তাই ‘আমি বিজয় দেখেছি বইটি লিখেছি-নতুন প্রজন্মের জন্য, তরুণদের জন্য এবং আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার জন্য।
সংকলন ও সম্পাদনায়:
শাফায়েত জামিল রাজীব
প্রধান সম্পাদক, একুশে টাইমস্