শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৪ অপরাহ্ন

আস্থার সংকট তৈরি করে বিদায় নিচ্ছে ইসি

আস্থার সংকট তৈরি করে বিদায় নিচ্ছে ইসি

একুশে ডেস্ক:

দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার চরম সংকট তৈরি করে বিদায় নিতে যাচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন। আগামী সোমবার নির্বাচন ভবনে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কমিশন সচিবালয় ত্যাগ করবেন তারা।

একই অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষায় অনূদিত ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৭৯২’ এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইন নিয়ে তৈরি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বর্তমান কমিশন বিদায় নিলেও যে আস্থার সংকট তৈরি করেছেন তা পূরণ হওয়া দুষ্কর-এমন মন্তব্য নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের।

তারা বলেন, কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়ে (২০১২-২০১৭) নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার সংকট তৈরি হয়। কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন মেয়াদের প্রথম দুই বছরে ইসির ওপর কিছুটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়। ইসির সংলাপ, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় অনেক নির্বাচনেও অংশ নেয় বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল। ওইসব নির্বাচনে ইসির নমনীয় ও বিতর্কিত অবস্থানই আস্থার এ সংকট তৈরি করেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কিছু পদক্ষেপে নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের কার্যক্রমে তারাই প্রমাণ করেছেন তারা পক্ষপাতদুষ্ট, তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের তথ্য তুলে ধরা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উলটো অনিয়মকে অস্বীকার করেছেন। নিুমানের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দুবার ফল প্রকাশ করে প্রমাণ করেছে এই মেশিনে জালিয়াতি করা যায়। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে আস্থার সংকট তৈরি করল তা সহজেই পূরণ হওয়ার নয়। এজন্য সঠিক ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত।

যদিও নির্বাচন কমিশনাররা বারবারই দাবি করে আসছেন, তারা আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করেছেন। নির্বাচনও আইনানুগ হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা আইনানুগভাবে সব নির্বাচন করেছি। গ্রহণযোগ্যতা বিষয়টি একেক জনের কাছে একেক ধরনের। তবে আমরা বলতে পারি, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু নির্বাচনের অয়িমের তথ্য সঠিক সময়ে না পেলে আমাদের কিছু করার থাকে না। কারণ আমরা সংবিধান ও আইন মেনে চলেছি।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন সিইসি কেএম নূরুল হুদা ও চার কমিশনার। আগামী সোমবার ১৪ ফেব্রুয়ারি তাদের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সার্চ কমিটি কাজ করছে। যে প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটি কাজ করছে তাতে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারির আগে নতুন কমিশন গঠনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এমন অবস্থায় কয়েকদিনের জন্য কমিশনারবিহীন থাকবে নির্বাচন কমিশন।

এর আগে ২০১৭ সালেও পাঁচ দিন সিইসি ছাড়াই চলেছে নির্বাচন কমিশন। ওই সময় ৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও তিনজন কমিশনারের মেয়াদ শেষ হয়। ওই কমিশনের আরেক সদস্য মো. শাহনেওয়াজের মেয়াদ শেষ হয় ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তবে বর্তমান কমিশনের পাঁচজনেরই মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি।

ইসি সূত্র জানায়, বর্তমান কমিশন বিদায় মুহূর্তে বেশ কিছু দৃশ্যমান কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পৃথক স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করতে যাচ্ছে। আগামী রোববার রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হবে। ওই কার্ডে নামের আগে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দ যুক্ত থাকছে।

ওই অনুষ্ঠানে সিইসি কেএম নূরুল হুদা, সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদসহ সরকারের এক ডজনের বেশি মন্ত্রী ওই স্মার্টকার্ড গ্রহণ করবেন। ওইদিন একশ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার হাতে এ কার্ড তুলে দেওয়া হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকার কথা রয়েছে।

একইদিন সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন সিইসিসহ পাঁচ কমিশনার। রাষ্ট্রপতির হাতে নির্বাচন কমিশনের একটি প্রতিবেদন তুলে দেওয়া হবে। আর রোববার নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্যোগে নির্বাচন কমিশনারদের বিদায়ি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। ওই সংবর্ধনায় পাঁচজন কমিশনারের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। এরপরই তারা কমিশন সচিবালয় থেকে বিদায় নেবেন।

প্রশংসা দিয়ে শুরু, বিতর্ক নিয়ে বিদায় : কেএম নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পরই প্রথম বড় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে। ২০১৭ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন সুষ্ঠু করায় প্রশংসিত হয় এই কমিশন। এরপর ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ হয়। ওই নির্বাচন নিয়েও প্রশংসিত হয়।

এছাড়া দায়িত্ব নেওয়ার পর নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী, এনজিও প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে সংলাপ করেও আলোচনায় ছিল কমিশন। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করে ইসি। ওই সময়ে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে সংস্কার আনার কথাও জানিয়েছিল ইসি।

বাস্তবে ওইসব সংস্কার প্রতিশ্রুতির তেমন কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। নির্বাচনের সময়ে অনিয়ম-আচরণবিধি লংঘনের ঘটনা দেখভালে ‘তৃতীয় চোখ’ নিয়োগ, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রকাশ্যে টানানো, ভোটকেন্দ্রের আধুনিকায়নের মতো অনেক প্রস্তাব বাস্তবায়ন তো করেনি, উলটো অনিয়মের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠলেও তা আমলে নেয়নি কমিশন। সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। উপরন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে দাবি করেছেন।

এছাড়া কমিশনারদের মধ্যকার দূরত্ব নিয়ে গত পাঁচ বছরই সমালোচনার মুখে ছিল কমিশন। সিইসির সঙ্গে চার কমিশনারের দূরত্ব এবং নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কয়েকবারের সংবাদ সম্মেলন আরও বিতর্কের তৈরি হয়। এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ এবং পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রশিক্ষণের নামে প্রায় সাড়ে সাত কোটি (সাত কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার) টাকা ভাতা নিয়ে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মধ্যে পড়ে এই কমিশন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও ইসির নীতিমালা ছাড়া এই অর্থ খরচ করায় আপত্তি জানায় স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত পদ ছাড়াই ‘বিশেষ বক্তা’, ‘কোর্স পরিচালক’ ও ‘কোর্স উপদেষ্টা’ হিসাবে ভাতা নেওয়া, নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাতা দেওয়া এবং খাত পরিবর্তন করে এসব টাকা ভাতা হিসাবে নেওয়া হয়।

ওই ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন মহাপরিচালককে বদলি করে কমিশন সচিবালয়। বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে অসদাচরণ এবং অনিয়মের অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল গঠনের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে দুই দফায় চিঠি দিয়েছিলেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক।

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana