শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫০ পূর্বাহ্ন

কুলিয়ারচরে প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়ি

কুলিয়ারচরে প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়ি

মোঃ মাইন উদ্দিন, কুলিয়ারচর প্রতিনিধি :
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও রয়েছে বিভিন্ন রকমের ঐতিহাসিক নিদর্শন। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে একটি হচ্ছে জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। আর এর সাথে এক-একটা জমিদার বাড়ির রয়েছে এক একরকম ইতিহাস।
ভারত উপমহাদেশে মুুঘল শাসনামল থেকে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা চালু ছিল। তবে ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্বে জমিদারি প্রথাকে “জায়গিরদারি” প্রথা বলা হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে জমিদার প্রথা চালু হয় অন্যরকম আধুনিকভাবে। কারণ ব্রিটিশরা এই জমিদারি প্রথাকেই ভারত উপমহাদেশকে আরো সহজভাবে শাসন করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। যা তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” নামে ১৭৯৩ সালে জায়গিরদারি প্রথা বিলুপ্ত করে জমিদারি প্রথা চালু করেন। যার ফলে এটি “জায়গিরদারি” প্রথা থেকে “জমিদারি” প্রথায় রূপ নেয়। কর্নওয়ালিশ নিজেও ব্রিটিশ এক জমিদার পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার এই জমিদারি প্রথা চালু করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল পুরো ভারতবর্ষ থেকে সহজে সরকারি রাজস্ব আদায় করা, সহজে ভারতবর্ষের মানুষকে তাদের শাসনকার্যের আওতায় রাখা।  মধ্যযুগীয় বা মুঘল শাসনামলের জমিদারি প্রথা আর এই জমিদারি প্রথা একদম আলাদা ছিল। তখনকার সময় ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমিদারি ক্রয় করে প্রজাদের উপর তাদের শাসনকার্য চালানোর জন্য একটি নির্ধারিত স্থানে প্রাসাদ তৈরি করে ঐ প্রাসাদে তারা বসবাস করতেন। আর ঐ জমিদারদের তৈরি করা বাড়িকেই জমিদার বাড়ি বলা হতো, বা এখনও হয়। জমিদাররা প্রজাদের উপর তাদের শাসনকার্য চালাতেন এই বাড়ি থেকেই। তাই জমিদারদের ঐ বাড়িগুলো প্রজা এবং সাধারণ মানুষের কাছে জামিদার বাড়ি নামেই পরিচিতি পায়। তখনকার সময় জমিদাররা ছিলেন অনেক ধন-সম্পদের মালিক। তারা তাদের বাড়িগুলো বানাতেন দালানের মধ্যে অপূর্ব কারুকাজ ও সুন্দর সুন্দর নকশা করে। যা বিভিন্ন জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখা যায়। আর এমনই এক জমিদার বাড়ি রয়েছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতী ইউনিয়নের ছয়সূতি গ্রামে।
স্থানীয়দের মতে প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন ঝঁরাঝির্ণ এই বাড়িটি প্রায় ২শত বছর আগে তৈরি করেছিলেন জমিদার প্রতাপ নাথ। ১শত ২১ শতাংশ ভূমির মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠিত ২শত বছর আগের পুরানো জমিদার বাড়িটি এখন এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন। জমিদার প্রতাপ নাথের নিকটাত্মীয়দের সাথে কথা হলে তারা জানান, জমিদার পরিবারের সর্বশেষ জমিদার ছিলেন প্রতাপ নাথ।
জমিদার বাড়ির পূর্ব দিকে কালী নদী বহমান। কালী নদীর পশ্চিম পাড় ঘেসে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া প্রতাপ নাথের বাজার। প্রতাপ নাথ নিজেই ২শ একর ৫৬ শতাংশ জমির উপর গড়ে তুলেছিলেন এই বাজার। বাজারটি করে সেসময় অনেক সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। তার করা বাজারটি আজও এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রতাপ নাথ বাজার নামে পরিচিত। বাজারটিতে এখন রয়েছে ছোট ছোট চারটি দোকান আর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকৃতির তিনটি বটগাছ। বাজারের দক্ষিণ পাশে রয়েছে প্রতাপ নাথ বাজার জামে মসজিদ, পূর্বপাশে কালী নদীর পাড় ঘেঁষে পোল্ট্রি মুরগীর ফার্ম, পশ্চিম পাশে মনজুরুল হামিদ শাহ্’র মাজার। বর্তমানে বাজারটির সরকারি ইজারা ২২ হাজার টাকা বলে জানা গেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাজারের কিছু জমি স্থানীয়দের দখলে চলে গেছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, জমিদার প্রতাপ নাথ হল বধু নাথের পুত্র শিব নাথের ছেলে। প্রতাপ নাথের দাদা বধুনাথ কখন থেকে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন তা কারোর জানা নেই। তবে শিব নাথের একমাত্র পুত্র ছিলেন জমিদার প্রতাপ নাথ। প্রতাপ নাথের বাড়টিতে এখন বসবাস করেন প্রতাপ নাথেরই বংশদর গিরিশ নাথের উত্তরসূরী।
সরেজমিন প্রতাপ নাথের বাড়িতে দাঁড়িয়ে কথা হয় গিরিশ নাথের পুত্রবধু মৃত নরেন্দ্র নাথের বৃদ্ধা স্ত্রী মঞ্জুশ্রী ও তার পুত্র তাপস চন্দ্র দেবনাথের সাথে, তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী জমিদার প্রতাপ নাথের জমির পরিমাণ ছিল ৮৪ ধুন। যা ১৬ কানিতে ১ ধুন হিসেব অনুযায়ী ১৩৩৪ কানি। অর্থাৎ ৪৭৪০ শতাংশ। প্রতাপ নাথের সমাধিস্থল কোথায় জানতে চাইলে তারা জানান, জমিদারি প্রথা শেষ হওয়ার পর প্রতাপ নাথ নিঃস্ব হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায় কলকাতায়। পরবর্তীতে তিনি দেশে এসে তার শশুর বাড়ি কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চল অষ্টমগ্রামের বাঙ্গালপাড়া গ্রামে পরলোক গমন করেন। বর্তমানে প্রতাপ নাথের উত্তরসূরী হিসেবে তাদের কি পরিমান জমি-জমা আছে জানতে চাইলে তারা জানান, শুধু এক একর ২১ শতাংশ বাড়ি আছে। অর্থাৎ মোট ১২১ শতাংশ ভূমি।
জমিদার প্রতাপ নাথের কয়টি ভবন ছিল তাও তারা জানেনা তারা। তবে যে ভবনটি এখন দাঁড়িয়ে আছে এর প্লাস্টার খসে পড়েছে, দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, কিছু জায়গায় ছাদও ধসে পড়েছে, ছাদের ওপর গাছের জন্ম হয়ে শিকড় ছাদ ও দেওয়াল বেয়ে নিচের দিকে আসছে। ভবনের ভিতরে দেখা গেছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। ভবনের দরজা জানালাও খুলে নিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একই সাথে প্রতাপ নাথ বাজারটি রক্ষার দাবিও করেন তারা। বাজারটির সঙ্গে জমিদার প্রতাপ নাথের  ইতিহাস লুকায়িত। বাজারটি সংরক্ষণ করাও খুব জরুরি। তা না হলে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে জমিদার প্রতাপ নাথের স্মৃতিবিজড়িত ভবন ও প্রতাপ নাথ বাজার।
Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana