শুক্রবার, ২০ Jun ২০২৫, ০৭:৩৮ অপরাহ্ন

তোমাকে অভিবাদন হে শহীদ কাদরী…

তোমাকে অভিবাদন হে শহীদ কাদরী…

একটু পেছন ফিরে দেখি।
সময়কাল ২৮ আগস্ট। সাল ২০১৬।
রোববার ছুটির দিন সকাল সকাল কানাডার সেইন্ট ক্যাথেরিন থেকে দিনু বিল্লাহর ফোন, আজ সকালে কবি শহীদ কাদরী মারা গেছেন!
খুবই অসুস্থ ছিলেন। হাসপাতালে ছিলেন। আইসিইউতে ছিলেন কয়েক দিন। কিন্তু তারপরেও শহীদ কাদরীর মৃত্যুসংবাদে খানিকটা বিস্মিতই হলাম। কারণ গতকাল রাতেই আকবর হায়দার কিরণের ফেসবুক স্ট্যাটাস মারফত জানতে পেরেছিলাম যে আইসিইউ থেকে তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং দুদিন পরেই বাসায় ফিরবেন শহীদ কাদরী। কিরণের স্ট্যাটাসে স্বস্তি ফিরে পেয়েছিলাম। আশাবাদী হয়েছিলাম। ভেবেই রেখেছিলাম বাসায় ফিরলেই টেলিফোনে কথা বলব প্রিয় শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে। কারণ এর আগেও বারকয় হাসপাতালে গেছেন এবং চিকিৎসা শেষে ফিরেও এসেছেন। এবারও ফিরবেন তিনি, সে রকমই প্রত্যাশা ছিল। আশাবাদ ছিল। কিন্তু আর কথা বলার সুযোগ থাকল না তার সঙ্গে। শহীদ ভাই চলেই গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এই তো মাত্র কয়েক মাস আগে, মে মাসের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্ক মুক্তধারার ২৫তম আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলায় গিয়ে দেখা হলো শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে। এর আগেও আমি মুক্তধারার বইমেলায় গিয়েছি কানাডা থেকে, কিন্তু শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি একবারও। যদিও টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা হতো নিয়মিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অতীতের দেখা না হওয়ার ঘাটতি এবার পুরণ হয়েছিল একাধিক সাক্ষাৎ ও আড্ডায়। তার বাড়িতে একদুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ এবং এক রাতের নৈশভোজসমেত বিপুল আড্ডার স্মৃতি এখনও সজীব আমার করোটির ভেতরে। ২০ মে দুপুরে ইকবাল হাসান আর শিখার সঙ্গে শহীদ ভাইয়ের বাড়িতে ভোজের নিমন্ত্রণে যেতে হয়েছিল তার স্ত্রী নীরা কাদরীর আন্তরিক আমন্ত্রণে। টেলিফোনে শহীদ ভাই বলেছিলেনÑআরে আসো তো! কতদিন দেখি না তোমাকে।
হ্যাঁ, বহুদিন, বহুকাল পর দেখা হলো কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে।
এর আগে, আমি বাংলাদেশে থাকাকালে, সর্বশেষ তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আশির দশকে, র‌্যাংকিন স্ট্রিটে, শহীদ ভাইয়ের বন্ধু মোশাররফ রসুল ও বিপ্লব দাশের নিবাসস্থলে। সেবার তিনি দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে গিয়েছিলেন দিনকয়েকের জন্যে। মোশাররফ রসুলের বাড়িতে সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডায় তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। সোফায় কাত হয়ে শুয়ে আসর মাত করা শহীদ কাদরী মাঝে মধ্যেই হেসে উঠছিলেন ছাদ কাঁপিয়ে। এমন নির্মল অট্টহাসি সবাই হাসতে পারে না। এর জন্যে যে প্রাণশক্তি লাগে শহীদ কাদরীর মধ্যে সেটার জোগান ছিল অফুরন্ত। ইমদাদুল হক মিলন এবং তাপস মজুমদারও ছিলেন সেই আড্ডায়। দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তির অধিকারী শহীদ কাদরীকে র‌্যাংকিন স্ট্রিটের সেই রাতের আড্ডার কথা মনে করিয়ে দিতেই বেদনার্ত হয়ে উঠেছিলেন শহীদ ভাই। কারণ তার বন্ধু মোশাররফ রসুল ও বিপ্লব দাশ প্রয়াত হয়েছেন আজ অনেক বছর। ঢাকার সাহিত্য জগতের দুই মহাইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার এই দুজন।
মুক্তধারার বইমেলায় মঞ্চে আটকে না থাকলে একটানা কোনো অনুষ্ঠানেই আমার থাকা হয়নি। কারণ আমার ছটফটে স্বভাব। যে কোনো পর্বে খানিকটা সময় থেকে সটকে পড়েছি। শুধু একটি আয়োজনে পুরোটা সময় ছিলাম, দর্শক আসনে। এক মুহূর্তের জন্যও উঠে যাইনি বা যেতে পারিনি। কারণ সেই পর্বে ছিল কবি শহীদ কাদরীর সঞ্চালনায় তারই কবিতার আবৃত্তি অনুষ্ঠান ‘কবিতাই আরাধ্য আমার’। তার এক একটি বহুল পঠিত পাঠকপ্রিয় কবিতার জন্মবৃত্তান্ত এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিষয়ে বলছিলেন স্বয়ং কবি শহীদ কাদরী এবং আবৃত্তিশিল্পীরা আবৃত্তি করছিলেন সেই কবিতাগুলো। এক কথায় দারুণ একটি সেগমেন্ট।
অডিটোরিয়াম পরিপূর্ণ ছিল। দর্শকসারিতে আমার খুব কাছেই বসে ছিলেন জার্মানি থেকে আসা নাজমুননেসা পিয়ারি। সবাই জানেন তিনি শহীদ কাদরীর প্রথম স্ত্রী। এককালে ঢাকার বিখ্যাত রূপসী কন্যা। আমার সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক পিয়ারি আপার। শহীদ কাদরী সম্পর্কে কত অজানা কথা যে আমার জানা হয়েছে পিয়ারি আপার কাছ থেকে! শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে একান্ত পারিবারিক ব্যক্তিগত সম্পর্কটি চুকেবুকে গেলেও এখনও ভালোবাসেন তিনি শহীদ কাদরীকে। সেদিন বিকেলেই চুপিচুপি জানতে চেয়েছিলাম, থাকবেন নাকি আপা শহীদ ভাইয়ের পর্বে? নাকি কেটে পড়বেন?
আমার প্রশ্নে খুব স্নিগ্ধ মিষ্টি হাসিতে উদ্ভাসিত তিনি বলেছিলেন, থাকব অবশ্যই।
হ্যাঁ, পুরো অনুষ্ঠানেই আমি লক্ষ করেছি পিয়ারি আপা অপার মুগ্ধতায় উপভোগ করছেন শহীদ কাদরীর প্রতিটি উচ্চারণ। তার কবিতার আবৃত্তিগুলোও তিনি উপভোগ করছেন বিমুগ্ধ শ্রোতার ভঙ্গিতে।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana