শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫৫ পূর্বাহ্ন
একুশে ডেস্ক:
ব্রিটিশ রাজশক্তি এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হল, সৃষ্টি হল ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের। স্বাধীন পাকিস্তানের দাবির মধ্যে ছিল বেঙ্গল ও আসাম। পুরোপুরি দুটো প্রদেশই পাকিস্তানের মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু যে শর্তে ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দিতে চাইল, তা হয়ে গেল অন্যরকম। ঠিক হলো, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে মুসলিম অধ্যুষিত পাঞ্জাব প্রদেশ। আসামকে স্বাধীন ভারতে রেখে অখ- বেঙ্গলকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না করে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত হলো, সিদ্ধান্ত এলো, আসামের বৃহত্তর সিলেট জেলায় গণভোট হবে এবং তার মাধ্যমে হবে এলাকার ভৌগোলিক ভাগ্য-নির্ধারণ।
১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই বৃহত্তর সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং ৫৫, ৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে সিলেট পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু গণভোটের রায় না মেনে মানচিত্রে দাগ কেটে বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ ভারতকে দিয়ে দেয়ায় সিলেটের মানুষের কাছেও চির বিতর্কিত হয়ে যায় র্যাথডক্লিফ লাইন। ফলে বাঙালি অধ্যুষিত তিন জেলা হালিয়াকান্দি, করিমগঞ্জ ও শিলচর নিয়ে গঠিত হলো বরাক উপত্যকা যা আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৫০ সাল পর্যন্ত আসামের বিধানসভায় বাংলাভাষার প্রচলন ছিল। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর কংগ্রেসের বিমলা প্রসাদ চালিহা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আসাম বিধান সভায় নতুন আইন ‘রাজ্য ভাষা বিল’ উত্থাপন করেন। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিধানসভায় এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়, উপেক্ষিত হয় রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। এ আইনের মাধ্যমে একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালিরা, ক্রম তা রূপ নেয় আন্দোলনে। প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস।
১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের দিনটি এ সংগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এ আন্দোলন তখনো ছিল সত্যাগ্রহ। শিলচরের কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সংকল্প নেয়া হয় এই দিনে। উদযাপিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসাবে গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালানোর হয়। আর সেই সূত্রে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। শত শত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দুই সপ্তাহ ধরে ২২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেন আন্দোলনকারীরা। ২ মে তারা করিমগঞ্জে এসে পৌঁছলে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেয়া হয়।
তারপর আসে ঐতিহাসিক ১৯ মে, ১৯৬১। বরাক উপত্যকায় হরতাল আহবান করা হয়। এদিকে হরতালের আগের দিন রাতে করিমগঞ্জে ব্যাপক ধরপাকড় চালায় পুলিশ, হামলা হয় গণপরিষদ কার্যালয়ে। পুলিশের এই মারমুখী আচরণে ফুঁসে ওঠে করিমগঞ্জ। জনতা বেরিয়ে আসে রাস্তায়। ১৯ মে সকাল থেকে সর্বত্র হরতাল পালিত হতে থাকে। শিলচরে রেলস্টেশনে সেদিন ভোর থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে আন্দোলনকারীরা। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। দোকানপাট যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। দুপুরের দিকে আন্দোলনের ব্যাপকতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে রাজ্য সরকার। এসময় পুলিশ গুলি ছুড়ে সত্যাগ্রহ এ আন্দোলনে। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ১১ জন, আহত হন অন্তত অর্ধশতাধিক। সেখানেই বাংলা ভাষার জন্য প্রথম নারী হিসেবে শহীদ হন ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য।
কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম অবিভক্ত বাংলার সিলেটে ১৯৪৫ সালে। পিতা রামরমন ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবী। সাত ভাইবোনের মধ্যে কমলা পঞ্চম আর বোনদের মধ্যে তৃতীয়। দেশভাগের পর কমলারা পাকিস্তানে থেকে গেলেও ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের গণহারে হত্যা ও উদ্বাস্তু কার্যক্রম শুরু হলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কমলার পরিবার। আর তারই রেশ ধরে সাত সন্তানকে নিয়ে বিধবা সুপ্রবাসিনী দেবী ভারতে পাড়ি জমান। পশ্চিমবস্তু হয়ে শিলচরে পা রেখেছিল কমলা।
কমলার শিক্ষা জীবন শুরু হয় ‘ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউট’ এর মধ্য দিয়ে। একে তো উদ্বাস্তু, তার উপর আর্থিক অনটন। কমলার বড় দিদি বেণু নার্সিং এর চাকুরী পেয়ে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান শিমুলগুড়ি। কমলার মেঝ দিদি প্রতিভা ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা। অর্থনৈতিকভাবে তার উপরই নির্ভর ছিল গোটা পরিবার। বই খাতা কেনার পয়সা ছিল না কমলার। সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার করে খাতায় টুকে নিয়ে পড়তো কমলা। শোনা যায়, একটি অভিধানের জন্য বোনকে বলেছিল। অর্থের অভাবে সেটাও কিনে দিতে পারেনি বোন। অভাবের মাঝে বড় হওয়া কমলা তবুও স্বপ্ন দেখে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করার, সেই সাথে টাইপরাইটিং শিখে একটা কেরানীর চাকুরী নিবে আর মায়ের দুঃখ দূর করবে। কমলা যখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী, বরাক উপত্যকা তখন উত্তাল ভাষার সংগ্রামে। অভাব অনটনে বড় হওয়া কমলা মনে মনে তখন ভীষণ লড়াকু। সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে সেও হয়ে উঠে সো”চার।
১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শিলচরের কাছাড়ে তখন গঠিত হয়েছে ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। সেখানেই নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় কমলা। সামনেই তখন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে চলে যায় সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীদের বক্তৃতা শুনতে। ১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে আন্দোলনকারীদের সংকল্প দিবসে সেও অংশগ্রহণ করে, শপথ নেয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এদিকে সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীরা ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু করে পদযাত্রা শেষ করে ২ মে শিলচরে পৌছায় নেতারা। কথা ছিল, ১৩ এপ্রিলের মধ্যে ভাষা বিল বাতিল না হলে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় সর্বাত্মক হরতাল। ১৮ মে ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিন। তাই পরীক্ষা শেষে হরতালে যেতে আর কোন বাধা নেই। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করলো কমলা। দেশ ছেড়ে আজ পরবাসে উদ্বাস্তু, এখন যে ভাষাটা নিজের ছিল, সেটাও আর থাকছে না- এই আকুতি গভীরভাবে নাড়া দেয় কমলাকে।
এদিকে কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী মেয়ের সবই বুঝেন, কিš‘ বাধা দেন না, নিরবে চোখের জল ফেলেন। মেজো বোন হরতালে যেতে নিষেধ করে, কিš‘ কিছুতেই কমলাকে আটকে রাখা যায়নি ঘরে।
১৯৬১ সালের ১৯ মে সকালে মেঝো বোন প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার জন্য রাখা শাড়ি আর ব্লাউজ পরেই কমলা বের হয়ে যান। যাওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় চেয়ে নেন, কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে যেন মুখে চেপে ধরতে পারে। যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে যেতে চেয়েছিলেন কমলা, কিন্তু ঘরে কিছুই না থাকায় খালি পেটেই বের হন তিনি। সাথে ছিল সবসময়ের সঙ্গী ১১ বছরের ছোট বোন মঙ্গলা। স্থানীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের ডাকে ২০/২২ জনের নারীর দলে যোগ দেন কমলা, উদ্দেশ্য শিলচর রেলওয়ে স্টেশন।
মায়ের মনে সেদিন কী উঠেছিল কে জানে! দুপুরের দিকে কমলার ছোট ভাই বকুল আর বড় বোনের ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে আসেন কমলার বিধবা মা সুপ্রবাসিনী দেবী। বকুল আর বাপ্পাকে প্রথমে পুলিশ ধরলেও পরে ছেড়ে দেয়। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মাকে আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন কমলা। সেই ছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাত।
এদিকে, আন্দোলনের তীব্রতায় হতচকিত রাজ্য সরকার, আসাম রাইফেল বাহিনীকে পাঠায় স্টেশনে। আন্দোনরত নেতাদের ধরে ট্রাকে তুলে নিতে উদ্ধত হলে জনতা ট্রাক অবরোধ করে। সকলের মুখে তখন স্লোগান ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।’ এসময় শুরু হয় আন্দোলনকারীদের উপর সরকারি বাহিনীর লাঠিচার্জ। লাঠিচার্জ থেকে বোনকে বাঁচাতে মঙ্গলাকে নিজের সাথে আকড়ে ধরেন কমলা। ২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ শুরু হয় ছাত্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে বিনা প্ররোচনায় ১৭ রাউন্ড গুলি করে পুলিশ। নিথর হয়ে লুটিয়ে পড়ে ১১ টি তাজাপ্রাণ।
তার মধ্যে একজন ছিল ১৬ বছরের কিশোরী একমাত্র নারী কমলা ভট্টাচার্য। একটি গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। আহত হয় মঙ্গলা। তার পাশেই লুটিয়ে পড়ে কমলা। মঙ্গলা হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ্য হয়ে উঠলেও চোখের সামনে বোনের মৃত্যু তাকে করে তোলে চিরদিনের জন্য অপ্রকৃতস্থ।
চাকরি আর করা হয়নি কমলার কিন্তু মাধ্যমিকে সে ঠিকই পাস করেছিল। জানা যায়, তার রেজাল্ট নিয়ে বিধবা মা আর্তনাদ করে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের মত স্বাধীন দেশের মানুষের হাতেই প্রাণ যাবে গো তোমার সন্তানের।’
স্বাধীন দেশে ১৯ মে ভাষা আন্দোলনের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। কমলার আত্মদান বৃথা যায়নি। কমলাসহ সেই ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় সরকার। কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে শিলচর স্টেশনের এক শহীদ বেদির উপর। শিলচর স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
২০১১ সালে, ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কমলার স্কুল প্রাঙ্গণে ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করা হয়। শিলচরের পাবলিক স্কুলের গা ঘেষে চলে যাওয়া সড়কটির নামকরণ করা হয় কমলা ভট্টাচার্য সড়ক। এই রাস্তার পাশেই ভাড়া থাকত উদ্বাস্তু কমলার পরিবার।
১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে শহীদ ১১ জনের তালিকা
১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, ২. শহীদ শচীন্দ্র পাল, ৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর, ৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী, ৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর, ৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব, ৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস, ৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস, ৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ, ১০. শহীদ সুনীল সরকার, ১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ। আসামে ১৯ মে এখনও ভাষাদিবস পালন করা হয়।