একুশে ডেস্ক:
দেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অতিসংক্রামক এই ভ্যারিয়েন্ট দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় গত এক সপ্তাহে করোনা রোগী বেড়েছে ২২৮ শতাংশ। এ সময় করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু বেড়েছে ১৮৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
করোনা সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ ১২ জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন অর্থাৎ রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে দেশে বুধবার আরও ৯ হাজার ৫০০ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি করোনার ভারতীয় (ডেল্টা) ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়েছিল।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকায় ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব বেশি। তীব্র ছোঁয়াচে এই ভ্যারিয়েন্ট যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে একদিনে ৩০ থেকে ৫০ হাজার নতুন রোগী শনাক্তের আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে চরম অনীহা দেখা যাচ্ছে। মহামারির বিপর্যয় ঠেকাতে টিকা নেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বিবেচনায় ৬৪ জেলাকে রেড, গ্রিন ও ইয়েলো রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে। শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি হলে তা লাল, শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের বেশি হলে অধিকতর গাঢ় লাল রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বুধবার থেকে গত এক সপ্তাহে ঢাকায় ৬২ হাজার ২১টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৭ হাজার ৪৩৭ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ১১ শতাংশ। এ কারণে ঢাকাকে সর্বোচ্চ ‘ঝুঁকিপূর্ণ জেলা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে সারা দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তের ৮০ শতাংশের কাছাকাছি রোগী পাওয়া যাচ্ছে ঢাকায়।
মঙ্গলবার সারা দেশে ৮ হাজার ৪০৭ জনের কোভিড শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ৫৯৭ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা, যা মোট আক্রান্তের ৭৮ শতাংশের বেশি। শনাক্তের হার বিবেচনায় দেশের জেলাগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে ১২ জেলা, মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে ৩১ জেলা এবং বাকি জেলাগুলোকে স্বল্পঝুঁকির এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উচ্চঝুঁকির জেলায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার গড়ে ১০ থেকে ১৯ শতাংশ। মাঝারি ঝুঁকির তালিকায় থাকা জেলাগুলোতে এই হার ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ। আর যেসব জেলায় শনাক্ত ৫ শতাংশের কম, সেগুলো কমঝুঁকির তালিকায় রয়েছে।
অধিদফতর জানিয়েছে, ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রাঙামাটি, বগুড়া, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, যশোর, লালমনিরহাট, গাজীপুর, পঞ্চগড় ও খাগড়াছড়ি জেলা রয়েছে উচ্চঝুঁকির রেড জোনে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
ইয়েলো জোন অর্থাৎ মধ্যম পর্যায়ের ঝুঁকিতে থাকা শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, ফেনী, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, সিলেট, নাটোর, কক্সবাজার, ঠাকুরগাঁও, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নওগাঁ, বরিশাল, মাগুরা, জয়পুরহাট, ঝালকাঠি, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট, শরীয়তপুর ও নড়াইলে শনাক্তের হার ৫ থেকে ৯ শতাংশ।
গ্রিন জোনে থাকা জেলার মধ্যে রয়েছে- কুমিল্লা, চাঁদপুর, পাবনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, ভোলা, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বরগুনা, চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী ও মেহেরপুর। এসব জেলার শনাক্তের হার শূন্য থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে। বান্দরবান জেলায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ হলেও একে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়নি, কারণ এ জেলায় খুব কমসংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্তের এই হার পাওয়া গেছে।
গত এক সপ্তাহে ৬১ জেলায় শনাক্তের হার আগের সপ্তাহের চেয়ে বেড়েছে, কমেছে তিন জেলায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে ঢাকায়, চট্টগ্রামে এই হার ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে রাঙামাটি জেলায়।
দেশে যে হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে তা অবশ্যই উদ্বেগজনক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, সারা পৃথিবীতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। ওমিক্রন দ্রুত সংক্রমিত হয়। ইউরোপ, আমেরিকা ও প্রতিবেশী ভারতের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিটি দেশেই ওমিক্রনের সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি আমরা দেখছি। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানছে না। কেউ মাস্ক পরে না। সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয় না। নির্বাচনসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর সময়ের আলোকে বলেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ওমিক্রনের সংক্রমণ শুরু হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে। তবে ঢাকায় ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব বেশি হচ্ছে, যা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। আর ঢাকার বাইরে ডেল্টার সংক্রমণ এখনও বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, অনেকেই মনে করছে আক্রান্ত বেশি হলেও ১০ থেকে ১২ জন মারা যাচ্ছে। অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পারছে না। এই মারা যাওয়াটা হচ্ছে গত ২৮ দিনের ফল। ওই সময় আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল। আর এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী ২৮ দিনে মৃত্যু অনেক বেড়ে যাবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।